অনুবাদ সাহিত্য | মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের ধারা

অনুবাদ সাহিত্য | মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের ধারা

মধ্যযুগের অনুবাদ সাহিত্যের ধারা, বাংলা অনুবাদ সাহিত্য, রামায়ন অনুবাদ, মহাভারত অনুবাদ, ভাগবতের অনুবাদ, কৃত্তিবাস ওঝা, মালাধর বসু, কাশীরাম দাস, গুণরাজ খান, ইত্যাদি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা না করে এখানে , প্রশ্নোত্তরে মূল পয়েন্টগুলি তুলে ধরা হল।

১। মধ্যযুগের বাংলা অনুবাদ সাহিত্য সৃষ্টির কারণ গুলি কী কী ?

উত্তরঃ- অনুবাদ সাহিত্য সৃষ্টির কারণ —
ক) তুর্কি আক্রমণের পরবর্তী বিপন্নতা।
খ) সংস্কৃত সাহিত্যে রসাস্বাদনের প্রতি আগ্রহ।
গ) হিন্দু সংস্কৃতির পুনরুত্থানের চেষ্টা।
ঘ) রাজকীয় পৃষ্টপোষনা।
ঙ) সক্ষম ও আগ্রহী কবির আবির্ভাব।

২। অনুবাদ সাহিত্যের প্রধান ধারা কয়টি ও কী কী? প্রতিটি ধারার শ্রেষ্ঠ অনুবাদকের নাম ও গ্রন্থের নাম লিখুন।
উত্তরঃ- অনুবাদ সাহিত্যের প্রধান ধারার তিনটি। যথা —
রামায়ণ মহাভারত ও ভাগবত।
রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা। গ্রন্থের নাম ‘শ্রীরাম পাঁচালী’।
মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস। গ্রন্থের নাম ‘ভারত পাঁচালী’।
ভাগবতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক মালাধর বসু।গ্রন্থের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’।

রামায়ণ অনুবাদ ধারা

৩। রামায়ণের আদি অনুবাদক কে? তাঁর কাব্যের নাম কী? তাঁর আবির্ভাবকাল সম্পর্কে প্রাপ্ত ভনিতাটি লিখুন।
উত্তরঃ- রামায়ণের আদি অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা।
তাঁর কাব্যের নাম ‘শ্রীরাম পাঁচালী’।
তাঁর আবির্ভাবকাল সম্পর্কে প্রাপ্ত ভনিতাটি হল —
“আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘ মাস।
তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।।“

৪। কৃত্তিবাসের পুঁথি কোথায় কবে প্রথম মুদ্রিত হয় ?
উত্তরঃ- ১৮০২-১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশনে উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ পাঁচটি খন্ডে প্রথম মুদ্রিত হয়।
১৮৩০-১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় দ্বিতীয় ও পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

৫। বাংলা রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে? তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ কী ?
উত্তরঃ- বাংলা রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা।
শ্রেষ্ঠত্বের কারণঃ-
ক) আক্ষরিক অনুবাদ না করে মর্মানুবাদ করা।
খ) ঘটনা ও চরিত্রের উপর বাঙালিয়ানার প্রভাব।
গ) সহজ-সরল ভাষায় অনুবাদ।
ঘ) পাঠকের উপযোগী করে কাহিনি বর্জন ও সংযোজন করা।

৬। বাংলা রামায়ণ ধারায় কৃত্তিবাসের জনপ্রিয়তার কারণ গুলি কী কী ?
উত্তরঃ- কৃত্তিবাসের জনপ্রিয়তার কারণ —
ক) বাঙালির প্রিয় পাঁচালীর ছন্দে অনুবাদ রচনা।
খ) ঘটনা ও চরিত্রে বাঙালির দৈনন্দিন জীবন উপস্থাপনা।
গ) দুর্বোধ্য কঠিন কাহিনী অংশ ত্যাগ করে বাঙালির প্রিয় বিষয় রূপে গ্রন্থ রচনা।
ঘ) সহজ সরল ভাষায় মর্মানুবাদ করে শ্রীরাম পাঁচালীকে বাঙালি ঘরের সামগ্রী করে তোলা।
৭। কৃত্তিবাসি রামায়ণের রচনাকাল ও কাব্য বৈশিষ্ট্য লিখুন।
উত্তরঃ- কৃত্তিবাসি রামায়ণের রচনাকাল ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দ। মতান্তরে ১৪৬৫ – ১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ।
কাব্য বৈশিষ্ট্য —
ক) বাঙালির প্রিয় পাঁচালীর ছন্দে রচিত।
খ) ঘটনা ও চরিত্রে বাঙালিয়ানার প্রভাব।
গ) সহজ-সরল ভাষায় অনুবাদ।
ঘ) করুণ রসের প্রাধান্য।
ঙ) বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের নিখুঁত আলেখ্য।

৮। কৃত্তিবাসের রামায়ণের কাহিনি কোন কোন উৎস থেকে চয়ন করা হয়েছে ?
উত্তরঃ- কৃত্তিবাসের রামায়ণের কাহিনি চয়ন করা হয়েছে —
জৈমিনী ভারত , বাল্মিকী রামায়ণ , অদ্ভুত রামায়ণ , পদ্মপুরাণ , স্কন্দ পুরাণ , মার্কেণ্ডীয় পুরাণ।

৯। বাল্মিকী রামায়ণের কিছু অংশ বর্জন করেছেন এবং কিছু অংশ কপোলকল্পিত —কৃত্তিবাস ওঝার এরকম দুটি করে কাহিনির উদাহরণ দিন।
উত্তরঃ- বর্জিত কাহিনি —
ক) কার্তিকের জন্ম।
খ) বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও অম্বরীষের যজ্ঞ।
কপোলকল্পিত কাহিনি —
ক) কৈকেয়ীর বরলাভ।
খ) লক্ষ্মণের শক্তিশেলে মূর্ছা।
গ) হনুমান কর্তৃক গন্ধমাদন পর্বত আনয়ন।
ঘ) লব কুশ যুদ্ধ।

১০। বাংলা রামায়ণের অন্য চারজন অনুবাদকের নাম গ্রন্থ ও আবির্ভাবকাল উল্লেখ করুন।
উত্তরঃ- অনুবাদকের নাম গ্রন্থ আবির্ভাবকাল
ক) অদ্ভুত আচার্য বা অদ্ভুত রামায়ণ সপ্তদশ শতক (১৬৪৭)
নিত্যানন্দ আচার্য
খ) চন্দ্রাবতী চন্দ্রাবতী রামায়ণ সপ্তদশ শতক
গ) দ্বিজ লক্ষ্মণ সপ্তদশ শতক
ঘ) শংকর কবিচন্দ্র রামলীলা বা অষ্টাদশ শতক (১৭০২)
শ্রীরাম মঙ্গল

১১। ‘শ্রীরাম পাঁচালী’র বা কৃত্তিবাসের রামায়ণের জনপ্রিয়তার কারণ কী ?
উত্তরঃ- ‘শ্রীরাম পাঁচালী’র জনপ্রিয়তার কারণ —
ক) রামায়ণ কাহিনির মধ্যে আছে সহজ-সরল ঋজুতা।
খ) বীর রসাত্মক মহাকাব্যের পরিবর্তে করুণ রসের পাঁচালী নির্মাণ।
গ) ঘটনা ও চরিত্রের উপর বাঙালিয়ানার প্রভাব।
ঘ) তত্ত্বকথার পরিবর্তে করুন ও হাস্য রসের আধারে কাহিনি বর্ণনা।
ঙ) তত্ত্ব প্রধান মহাভারত ও ভাগবত অনুবাদ ধারা রামায়ণ অনুবাদ ধারার কাছে পরাজিত হয়।

ভাগবত অনুবাদ ধারা


১। বাংলা সাহিত্যে প্রথম সরাসরি রচনাকাল জ্ঞাপক ভণিতা কোনটি ? কার রচনা ? এর থেকে রচনাকাল কী জানা যায় ?
উত্তরঃ- বাংলা সাহিত্যে প্রথম সরাসরি রচনাকাল জ্ঞাপক ভণিতা হল —
“তেরশ পঁচানই শকে গ্রন্থ আরম্ভন ।
চতুর্দশ দুই শকে হৈল সমাপন ।।“
এই রচনাকাল জ্ঞাপক ভনিতাটির রচয়িতা মালাধর বসু ।
এর থেকে রচনাকাল যে সাল পাওয়া যায় —
তেরশ পঁচানই শক = ১৩৯৫ শকাব্দ ।
চতুর্দশ দুই শক = ১৪০২ শকাব্দ ।
১৩৯৫+৭৮=১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দ ।
১৪০২+৭৮=১৪৮০ খ্রিস্টাব্দ ।
অর্থাৎ ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রিস্টাব্দ ।

২। বাংলা ভাগবত অনুবাদ ধারার শ্রেষ্ঠ কবি কে ? তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন ।
উত্তরঃ- বাংলা ভাগবত অনুবাদ ধারার শ্রেষ্ঠ কবি মালাধর বসু ।
মালাধর বসুর সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ-
মালাধর বসুর আবির্ভাব পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে । বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রামে কবির জন্ম হয়েছিল । কবির পিতার নাম ভগীরথ ও মাতার নাম ইন্দুমতী । তিনি প্রথম ভাগবতের অনুবাদক । ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য রচনায় মালাধর বসুর কৃতিত্ব ও পান্ডিত্যের জন্য গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বরবক শাহ তাঁকে ‘গুনরাজ খান’ উপাধি দেন ।

৩। মালাধর বসু ভাগবতের কোন কোন অংশ অনুবাদ করেন ? এই অনুবাদে তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দিন ।
উত্তরঃ- মালাধর বসু ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধের অনুবাদ করেন ।
মালাধর বসুর কৃতিত্বঃ-
ক) ভাগবত অনুবাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মালাধর বসু স্পষ্টতই লিখেছেন —
“ভাগবত অর্থ যত পয়ারে বান্ধিয়া ।
লোকনিস্তারিতে গাই পাঁচালী রচিয়া ।।“
খ) ভাগবতের মতো বাঙালির অপ্রিয় কঠিন তত্ত্ব থেকে গ্রহণযোগ্য তিনটি কাহিনি বৃত্ত (বৃন্দাবনলীলা , মথুরালীলা ও দ্বারকালীলা) নির্বাচন করা ।
গ) নিসর্গ চিত্র , মা ও সন্তানের সম্পর্ক , বাঙালির গার্হস্থ্য জীবন চিত্র সহজ সরল ভাষায় তুলে ধরা ।

৪। শ্রীকৃষ্ণবিজয় কী জাতীয় রচনা ? রচয়িতার নামসহ রচনাটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন ।
উত্তরঃ- শ্রীকৃষ্ণবিজয় অনুবাদ ধর্মী রচনা ।
শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ-
কাব্য নাম – ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ ।
রচয়িতা – মালাধর বসু ।
রচনাকাল – ১৪৭৩-৮০ খ্রিষ্টাব্দ ।
কাব্যের পৃষ্ঠপোষক – রুকনুদ্দিন বরবক শাহ ।
কাব্যের অন্য নাম – গোবিন্দবিজয় বা গোবিন্দমঙ্গল ।
উদ্দেশ্য – “লোকনিস্তারিতে গাই পাঁচালী রচিয়া ।“ — অশিক্ষিত বা সাধারণ মানুষকে কৃষ্ণ কথা শোনানোর জন্য মালাধর বসু পাঁচালি রচনা করেন ।

৫। কে কাকে কেন ‘গুণরাজ খান’ উপাধি দেন ?
উত্তরঃ- মালাধর বসু লিখেছেন —
“গুণ নাহি অধম মুই নাহি কোন জ্ঞান ।
গৌড়েশ্বর দিলা নাম গুনরাজ খান ।।“
গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বরবক শাহ মালাধর বসুকে ভাগবত অনুবাদের কৃতিত্বের জন্য ‘গুণরাজ খান’ উপাধি দান করেন ।

৬। ভাগবতের অনুবাদের ধারাটি স্তিমিত হয়ে পড়ে কেন ?
উত্তরঃ- ভাগবতের অনুবাদের ধারাটি স্তিমিত হয়ে পড়ার মূল কারণ গুলি হল —
ক) মূল ভাগবতে জনপ্রিয় আখ্যানের অভাব ।
খ) কঠিন তত্ত্বকথা গল্পভুক বাঙালির অপ্রিয় ।
গ) সক্ষম ও সফল কবির অপ্রতুলতা ।
ঘ) রামায়ণ মহাভারতের মতো জনপ্রিয় আখ্যানের কাছে প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া ।

মহাভারত অনুবাদ ধারা

১। বাংলা মহাভারতের আদি অনুবাদক কে ? তাঁর গ্রন্থটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও ।
উত্তরঃ- বাংলা মহাভারতের আদি অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর।
সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ-
কবীন্দ্র পরমেশ্বরের গ্রন্থের নাম ‘পাণ্ডব বিজয়’ । আনুমানিক ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে গ্রন্থটি রচিত হয় । বাংলার শাসনকর্তা হুসেন শাহের রাজত্বকালে গ্রন্থটি রচনা করেন । আঠারো পর্বে রচনাটি সমাপ্ত হয় । তাঁর কাব্যের কৃতিত্বের জন্য পরাগল খাঁ তাঁকে ‘কবীন্দ্র’ উপাধি দেন । তিনিই প্রথম বাংলা মহাভারতের রচয়িতা ।

২। বাংলা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে ? তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ গুলি লিখুন ।
উত্তরঃ- বাংলা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস।
কাশীরাম দাসের শ্রেষ্ঠত্বের কারণঃ-
ক) আক্ষরিক অনুবাদ না করে মর্মানুবাদ করা ।
খ) মহাকাব্যিক ক্লাসিকাল গাম্ভীর্য ত্যাগ করে পাঁচালী নির্মাণ ।
গ) ভাষার গাম্ভীর্য নির্মাণ ।
ঘ) ঘটনা ও চরিত্রের বাঙালিয়ানা ।
ঙ) সহজ-সরল ভাষায় কাহিনী বর্ণন ।

৩। কাশীরাম দাস মহাভারতের কোন কোন অংশ অনুবাদ করেন ? এসম্পর্কে ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরামের উদ্ধৃতিটি লিখুন ।
উত্তরঃ- কাশীরাম দাস মহাভারতের আদিপর্ব , সভাপর্ব , বন পর্ব ও বিরাট পর্বের কিছুটা অংশ অনুবাদ করেন ।
এসম্পর্কে ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরামের উদ্ধৃতিটি হল —
“আদি সভা বন বিরাটের কতদূর ।
ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর ।।“

৪) কাশীরাম দাসের মহাভারতের নাম কী ? তিনি ছাড়া আর কে কে এই গ্রন্থ অনুবাদে সাহায্য করেন ?
উত্তরঃ- কাশীরাম দাসের মহাভারতের নাম ‘ভারত পাঁচালী’ ।
এই গ্রন্থ অনুবাদে সাহায্য করেন নন্দরাম , কৃষ্ণানন্দ বসু , জয়ন্ত দাস , অনন্ত মিশ্র ও দ্বিজ হরিদাস ।

৫। কাশীরাম দাস মহাভারতের অনুবাদে কোন কোন উৎস থেকে কাহিনি চয়ন করেন ?
উত্তরঃ- কাশীরাম দাস মহাভারতের যে যে উৎস থেকে কাহিনি চয়ন করেছেন — ব্যাসদেবের মহাভারত , ভারত সংহিতা , পুরাণ , উপপুরাণ ও জৈমিনি ভারত ।

৬। কাশীরাম দাস মূল মহাভারতের কোন কোন অংশ বর্জন করেছেন এবং কোন কোন কাহিনি সংযোজন করেছেন — দুটি করে উদাহরণ দিন ।
উত্তরঃ- কাশীরাম দাস মহাভারতের যে যে অংশ বর্জন করেছেন এমন দুটি উদাহরণ —
ক) রুরুর প্রেম কাহিনি ।
খ) বিদুলতার তেজস্বিতা ।
গ) মার্কেণ্ডেয় পর্ব ।
কাশীরাম দাস মহাভারতের যে যে অংশ সংযোজন করেছে এমন দুটি উদাহরণ —
ক) শ্রীবৎসচিন্তা উপাখ্যান ।
খ) সুভদ্রাহরণ কাহিনি ।
গ) ভানুমতির স্বয়ংবর সভা ।
ঘ) অকালে আম্রোৎপত্তির বিবরণ ।

৭। কাশীরাম দাসের মহাভারতের জনপ্রিয়তার কারণ গুলি কী কী ?
উত্তরঃ- মহাভারতের জনপ্রিয়তার কারণঃ-
ক) আক্ষরিক অনুবাদ না করে মর্মানুবাদ করা ।
খ) কঠিন তত্ত্ব কথা অংশ বর্জন ।
গ) ঘটনা ও চরিত্রে বাঙালিয়ানার প্রভাব ।
ঘ) উপমা অলংকার হাস্যরস মিলিয়ে সুখপাঠ্য করে তোলা ।
ঙ) মহাকাব্যিক ক্লাসিকাল গাম্ভীর্যের উপর পাঁচালী নির্মাণ ।

৮। কাশীরাম ছাড়া অন্য চারজন মহাভারতের অনুবাদকের নাম ও তাঁদের কাব্যের নাম লিখুন ।
উত্তরঃ- অনুবাদক কাব্য-নাম
কবীন্দ্র পরমেশ্বর পাণ্ডব বিজয়
শ্রীকর নন্দী অশ্বমেধ কথা
সঞ্জয় মহাভারত
দ্বিজ রঘুনাথ অশ্বমেধ পাঁচালী

কয়েকজন অনুবাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

১। কৃত্তিবাস ওঝাঃ-

রামায়নের আদি ও শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা । তাঁর আবির্ভাবকাল সম্পর্কে প্রাপ্ত ভনিতাটি হল —
“আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘ মাস ।
তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস ।।“
তিনি নদিয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রবিবার জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম বনমালী এবং মাতার নাম মালিনী । তাঁর কাব্যের নাম ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ ।

২। মালাধর বসুঃ-

বাংলা ভাগবত অনুবাদ ধারার শ্রেষ্ঠ কবি মালাধর বসু । মালাধর বসুর আবির্ভাব পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে । বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রামে কবির জন্ম হয়েছিল । কবির পিতার নাম ভগীরথ ও মাতার নাম ইন্দুমতী । তিনি প্রথম ভাগবতের অনুবাদক । ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য রচনায় মালাধর বসুর কৃতিত্ব ও পাণ্ডিত্যের জন্য গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বরবক শাহ তাঁকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধি দেন ।

৩। কাশীরাম দাসঃ-

বাংলা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস । আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম কমলাকান্ত দেব । দেব তাঁদের কৌলিক উপাধি ছিল । কাশীরাম দাসের অনূদিত মহাভারতের নাম ‘ভারত পাঁচালী’ ।

৪। অদ্ভুত আচার্যঃ-

অদ্ভুত আচার্য চৈতন্য পরবর্তী রামায়ণ অনুবাদক । অনেকের মতে ষোড়শ শতকে তাঁর জন্ম । ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে তিনি আনুমানিক ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাবনার উত্তর-পূর্বে সোনাবাজু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতার নাম শ্রীনিবাস আচার্য এবং মাতার নাম মেনকা দেবী । তাঁর প্রকৃত নাম নিত্যানন্দ আচার্য। ১৩২০ সালে ‘রংপুর সাহিত্য পরিষদ’ থেকে রজনীকান্ত চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণ’ প্রকাশিত হয় ।

৫। শ্রীকর নন্দীঃ-

শ্রীকর নন্দী চৈতন্য পূর্ব যুগের কবি । বাংলা ভাষায় প্রথম মহাভারতের অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বরের সমসাময়িক কবি শ্রীকর নন্দী । তিনি পরাগল খাঁর পুত্র ছুটি খাঁর সভাসদ ছিলেন । ছুটি খাঁর নির্দেশে তিনি কেবল মহাভারতের ‘অশ্বমেধ পর্ব’টি অনুবাদ করেন ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে । ছুটি খানের নির্দেশে রচিত হয়েছিল বলে শ্রীকর নন্দী কাব্য ‘ভারত পাঁচালী’ বা ‘ছুটিখানী মহাভারত’ নামে পরিচিত।

৬। সঞ্জয়ঃ-

সঞ্জয় চৈতন্য পূর্ব যুগের কবি । ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে সঞ্জয় মহাভারতের আদি অনুবাদক। সমালোচকদের মতে তাঁর কাব্য ষোড়শ শতকে রচিত । অবশ্য দীনেশচন্দ্র সেন সঞ্জয়ের কুলপরিচায়ক যে পয়ারটি উদ্ধার করেছেন সেটি হল —
“ভরদ্বাজ উত্তম বংশেতে যে জন্ম ।
সঞ্জয় ভারত কথা কহিলেক মর্ম ।।“
বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’এ রক্ষিত এক পুঁথিতে পেয়েছেন —
“দেববংশে উৎপত্তি ব্রাহ্মণকুমার ।
সঞ্জয় রচনা কৈল পাঁচালী প্রকার ।।“

৭। চন্দ্রাবতীঃ-

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী । মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতী । তাঁর মায়ের নাম সুলোচনা । তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর কবি । তাঁর অনূদিত রামায়ণ গ্রন্থটি ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ নামে পরিচিত ।

৮। কবীন্দ্র পরমেশ্বরঃ-

বাংলা মহাভারতের আদি অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর । তিনি ত্রিপুরা ও চট্টগ্রামে শাসনকর্তা পরাগল খাঁর সভাসদ ছিলেন । কবীন্দ্র পরমেশ্বরের গ্রন্থের নাম ‘পাণ্ডব বিজয়’ । আনুমানিক ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে গ্রন্থটি রচিত হয় । বাংলার শাসনকর্তা হুসেন শাহের রাজত্বকালে গ্রন্থটি রচনা করেন । তাঁর কাব্যের কৃতিত্বের জন্য পরাগল খাঁ তাঁকে ‘কবীন্দ্র’ উপাধি দেন । পরাগল খাঁর নির্দেশে রচিত হয়েছিল বলে কাব্যটি ‘পরাগলী মহাভারত’ নামে খ্যাত।

Leave a Reply