বাংলা নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান আলোচনা করো।
বাংলা নাট্য সাহিত্যে মধুসূদনের পর দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাব । তিনি মধুসূদন পূর্ববর্তী নাট্যকারদের মধ্যে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছেন । সমসাময়িক সামাজিক জীবনের উজ্জ্বল আলেখ্য হিসেবে তাঁর নাটক গুলির স্বতন্ত্র মর্যাদা রয়েছে ।
তাঁর রচিত নাটক গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল —
ক) সামাজিক নাটক – ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০) ।
খ) রোমান্টিক নাটক – ‘নবীন তপস্বিনী’ (১৮৬৩), ‘লীলাবতী’ (১৮৬৭), ‘কমলে কামিনী’ (১৮৭৩) ।
গ) প্রহসন বা কৌতুকধর্মী নাটক – ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ (১৮৬৬) , ‘সধবার একাদশী’ (১৮৬৬) , ‘জামাই বারিক’ (১৮৭২) ।
তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ‘কেনচিৎ পথিকেনাভি প্রণীত’ ছদ্মনামে রচিত । এই নাটকে গ্রামবাংলার প্রজাদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের চিত্র তিনি বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন । নীলকর সাহেবরা চাষীদের জোর করে নীল চাষের জন্য যে অমানসিক অত্যাচার ও নির্যাতন সমকালকে কলঙ্কিত করেছিল দীনবন্ধু তাকেই নাট্য সাহিত্যে মূর্ত করে তুলেছেন তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটকে ।
‘লীলাবতী’ নাটকে কলকাতা শহরতলীর বাস্তব চিত্র ও হাস্য পরিহাস মুখর বিচিত্র বর্ণনার মধ্য দিয়ে একটি সমস্যাসঙ্কুল পরিবেশের সন্ধান পাই । এখানে একটি রোমান্টিক প্রেমের ছবি রয়েছ ।
তাঁর প্রহসন গুলির মধ্যে ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ বৃদ্ধের বিবাহের বিড়াম্বনা হাস্যকর অসঙ্গতির মধ্য দিয়ে বর্ণিত হয়েছে । ‘জামাই বারিক’ প্রহসনে ধনী সমাজে ঘর জামাই পোষার প্রবণতার মধ্যে যে নির্লজ্জতা ও স্বার্থপরতা এবং নিষ্ক্রিয় মানসিকতাকে হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে । ‘সধবার একাদশী’তে সেকালের কলকাতার শিক্ষিত ও অশিক্ষিত যুব শক্তির মধ্যে বারাঙ্গনা সেবা , পরস্ত্রীহরণ প্রভৃতি ব্যভিচারী দিকগুলি যে কুৎসিত পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার কাহিনি বর্ণিত ।
পরিশেষে বলা যায় যে , বাংলা নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্র স্বয়ং একটি অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছেন । নাট্যসাহিত্যে তাঁর এই অবদানের জন্য আজও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ।
নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান আরো বিস্তারিত আলোচনা। 👇👇👇 PDF সহ
দীনবন্ধু মিত্রের নাটক ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ
দীনবন্ধু মিত্র চারটি পূর্ণাঙ্গ নাটক ও তিনটি প্রহসন রচনা করেন। এছাড়াও একটি অপ্রকাশিত ক্ষুদ্র নাটিকাও তিনি লিখেছিলেন।
১. নীলদর্পণ (১৮৬০)
- বিষয়ঃ বাংলায় নীলচাষীদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও তার কুফল ।
- অঙ্ক সংখ্যা- ৫টি।
- উল্লেখযোগ্য চরিত্রঃ গোলোক বসু, নবীনমাধব, সাবিত্রী, সৈরিন্ধ্রী, ক্ষেত্রমণি, সাধুচরণ, তোরাপ, আদুরি , রায়চরণ, পি পি রোগ।
- উৎসর্গ – ভুমিকায় লেখা ছিল ”নীলকরনিকরকরে নীল-দর্পণ অর্পণ করিলাম।”
- নাটকটি ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর প্রথম অভিনীত হয়।
- দীনবন্ধুর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নাটক।
- ‘Nil Darpan, or The Indigo Planting Mirror ‘ এই নামে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকের অনুবাদ করেছেন।
- এটিই প্রথম বাংলা নাটক যা ইংরেজিতে অনূদিত হয়।
২. নবীন তপস্বিনী (১৮৬৩)
- অঙ্ক সংখ্যাঃ ৫ টি।
- উল্লেখযোগ্য চরিত্রঃ রমণীমোহন, জলধর, বিনায়ক, মাধব, মালতী, মল্লিক্ জগদম্বা ।
- উৎসর্গঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে।
- নাটকটি ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি প্রথম অভিনীত হয়।
৩. বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬) প্রহসন
- মধুসুদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’-এর অনুকরণে রচিত ।
- বিষয়ঃ একটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত হাস্যরসাত্মক প্রহসন।
- অঙ্ক সংখ্যাঃ ২টি।
- প্রধান চরিত্রঃ নসিরাম, রাজীবলোচন, রামমণি, ভূবনমোহন ।
- উৎসর্গ – শারদাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়কে।
৪. সধবার একাদশী (১৮৬৬) প্রহসন
- মধুসূদনের ‘একেই কী বলে সভ্যতা’-র অনুকরণে রচিত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রহসন।
- বিষয়ঃ পাশ্চাত্য প্রভাবপুষ্ট নবীন যুব সম্প্রদায়ের অনাচার ও তার প্রতিকারের ভাবনা নিয়ে প্রহসনটি রচিত।
- অঙ্ক সংখ্যাঃ ৩টি।
- মূল চরিত্রঃ অটলবিহারী, গোকুলচন্দ্র, সৌদামিনী, নিমচাঁদ, কুমুদিনী, নকুলেশ্বর।
- নাটকটি ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর প্রথমবার অভিনীত হয়।
৫. লীলাবতী (১৮৬৭)
- বিষয়ঃ কোলকাতার শহরতলী নিয়ে লেখা রোম্যান্টিক হাস্যরস নির্ভর প্রহসন।
- অঙ্ক সংখ্যাঃ ৫টি।
- প্রধান চরিত্রঃ হরবিলাস, অরবিন্দ, শ্রীনাথ, লীলাবতী, ক্ষীরোদবাসিনী, রাজলক্ষ্মী লোলিত মোহন ।
- উৎসর্গঃ গুরুচরণ দাসকে।
৬। জামাইবারিক (১৮৭২)
- বিষয়ঃ ধনী সমাজে ঘর জামাই রাখার প্রবণতার মধ্যে যে নির্লজ্জতা ও স্বার্থপরতা এবং নিষ্ক্রিয় মানসিকতার অসুস্থতা বিদ্যমান তা হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে।
- প্রধান চরিত্রঃ বিজয় বল্লভ, অভয়কুমার, পদ্মলোচন, কামিনী, বিন্দুবাসিনী।
- অঙ্ক সংখ্যাঃ ৪টি।
- উৎসর্গঃ নাটকটি উৎসর্গ করা হয় রাসবিহারী বসুকে।
- নাটকটি ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই ডিসেম্বর প্রথম অভিনীত হয়।
৭. কমলে কামিনী নাটক (১৮৭৩)
- দীনবন্ধু মিত্রের শেষ নাটক ।
- অঙ্ক সংখ্যাঃ ৫টি।
- উল্লেখযোগ্য চরিত্রঃ রাজা, বীরভূষণ, সমরকেতু, গান্ধারী, সুশীলা, সুরবালা । সুরবালা চরিত্রে বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের বিমিলা চরিত্রের প্রভাব দেখা যায়।
- উৎসর্গ করেছেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে।
৮। কুড়ে গোরুর ভিন্ন গোঠ ( অপ্রকাশিত)
- ক্ষুদ্র নাটিকা।
- দৃশ্যঃ ২ টি।
- উল্লেখযোগ্য চরিত্রঃ ভোদা, গোমা, স্বার্থক, বলদ ।
দীনবন্ধু মিত্রের নাট্য বৈশিষ্ট্য
- দীনবন্ধু বাংলা সাহিত্যের বাস্তবতার অগ্রদূত এবং তিনি বোধহয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রধান বাস্তববাদী লেখক।
- তখনকার মত এখনো বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে দীনবন্ধু ‘নীলদর্পণ’ ও ‘সধবার একাদশী’ অভিনীত হয়। বিশেষ করে নীলদর্পণের নাট্যকার হিসাবে তার খ্যাতি চূড়ান্ত।
- দীনবন্ধুর শিল্প মানুষের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য তার বস্তু চেতনা, এই বস্তুচেতনার উৎস
কিন্তু পুথির জগত বা চিন্তার জগৎ নয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজাত।
- সব ধরণের নাট্য সৃষ্টিতে দীনবন্ধু সফল । ট্রাজেডিটি, কমেডি বা প্রহসন প্রতিটি সৃজনরূপেই
দীনবন্ধুর প্রতিভা দীপ্ত ।
- উচ্চশ্রেণির চরিত্রে দীনবন্ধু সফল না হলেওসাধারণ অতি সামান্য চরিত্রের অঙ্কনে তিনি অত্যন্ত সফল, তার তোরাপ, আদুরী ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়।
দীনবন্ধুর নাটক রচনার ক্ষেত্রে প্রেরণা দান করেছে বাঙালির শাশ্বত জীবনবোধ ও সমকালের বিক্ষুদ্ধ গণজীবন। সমসাময়িক বিক্ষুব্ধ গণজীবনের সঙ্গে একতা অনুভব করেছিলেন বলেই “নির্যাতিত জীবনের সহানুভূতিশীল বাণীকার” রূপে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
Important SAQ question 👇👇
1) দীনবন্ধু মিত্রের জন্ম সাল কত ?
উঃ ১৮৩০
2) দীনবন্ধু মিত্রের ‘নবীন তপস্বিনী’ নাটকটি কাকে উৎসর্গ করেন ?
উঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
3) নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদের নাম কী ? কার নামে প্রকাশিত হয় ? প্রকাশকের কী শাস্তি হয়েছিল ?
উঃ ‘‘Nil Darpan, or The Indigo Planting Mirror ‘’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনূবাদ করলেও পাদ্রী লঙ সাহেবের নামে প্রকাশিত হয়। লঙ সাহেবের ১ মাসের কারাদণ্ড ও ১০০০ টাকা জরিমানা হয়। আদালতের জরিমানার টাকা দেন কালিপ্রসন্ন সিংহ ।
4) নীলদর্পণ নাটকটি কোথায় কবে প্রথম অভিনয় হয় ?
উঃ ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ৭ই ডিসেম্বর প্রথম অভিনীত হয়।
5) নিমচাঁদ দীনবন্ধু মিত্রের কোন নাটকের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র ?
উঃ সধবার একাদশী ।
6) নীলদর্পণ নাটকটি কাকে উৎসর্গ করেন ?
উঃ ভুমিকায় উৎসর্গ স্থলে লেখা ছিল “নীলকরনিকরকরে নীল-দর্পণ অর্পণ করিলাম।”
7)মধুসূদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ অনুকরণে দীনবন্ধু মিত্র কোন নাটকটি রচনা করেছেন ?
উঃ ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো।’
8) ‘সধবার একাদশী’’ নাটকে মোট কটি অঙ্ক রয়েছে ?
উঃ ৩টি ।
9) ‘কমলে কামিনী নাটক’ এর প্রকাশকাল কত ?
উঃ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ ।
10) ‘জামাই বারিক’ নাকটি কাকে উৎসর্গ করেন ?
উঃ রাসবিহারী বসুকে ।
11) দীনবন্ধু মিত্রের দুটি গদ্য স্কেচ জাতীয় রচনার নাম কী ?
উঃ ‘পোড়া মহেশ্বর’ ও ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’।
12) দীনবন্ধু মিত্রের কাব্য-কবিতাগুলির নাম কী ?
উঃ দীনবন্ধু মিত্রের কাব্য-কবিতাগুলির নাম হল- ‘সুরধনী কাব্য’ , ‘দ্বাদশ কবিতা’ ও ‘নানা কবিতা’ ।
নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান এর PDF টি ডাউনলোড করে নাও। 👇👇
আরো দেখে রাখতে পারো👇👇👇
নাট্যসাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান
নাট্যসাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান
নাট্যসাহিত্যে মধুসূদন দত্ত-র অবদান
বাংলা কাব্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত-র অবদান
বাংলা কাব্যে কবি-মাইকেল মধুসূদন দত্তর অবদান
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর অবদান
বাংলা কাব্যে কবি মোহিতলাল মজুমদারের অবদান
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-র অবদান
বাংলা কাব্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান
গীতিকবিতার ভোরের পাখি কাকে বলে হয় ? বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান আলোচনা করো ।
বাংলা কাব্য সাহিত্যে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা কাব্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা কাব্যে বিষ্ণু দে-র অবদান আলোচনা
আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের অবদান
গদ্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান
প্রবন্ধ সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান
প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর অবদান
প্রবন্ধ সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান
কথাসাহিত্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান
কথাসাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান
কথাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান
উপন্যাস সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান
বাংলা ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান