১। শিবায়ন কী ?
মধ্যযুগে রচিত শিব মাহাত্ম্য কথা বর্ণিত হয়েছে যে কাব্যে সেই কাব্যকেই বলে শিবায়ন কাব্য।
২। শিবায়ন কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন।
শিবায়ন কাব্য মধ্যযুগে রচিত বাংলা আখ্যানকাব্যের একটি ধারা। শিব ও দুর্গার মানবিক , কৃষক সমাজের দরিদ্র সংসার জীবন কল্পনা করে মঙ্গলকাব্যের আদলে এই কাব্যধারার উদ্ভব ঘটে।
শিবায়ন কাব্যে দুটি অংশ দেখা যায়ঃ – পৌরাণিক ও লৌকিক। মঙ্গলকাব্যের আদলে রচিত হলেও শিবায়ন মঙ্গলকাব্য নয়, মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে এক কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই কাব্যের দুটি ধারা দেখা যায়। প্রথমটি শিবপুরাণ-নির্ভর শিবায়ন কাব্য ও দ্বিতীয়টি মৃগলুব্ধ-মূলক উপাখ্যান।
শিবায়নের প্রধান কবিরা হলেনঃ রতিদেব, রামরাজা, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, রামচন্দ্র কবিচন্দ্র ও শঙ্কর কবিচন্দ্র।
৩। শিবায়ন কী প্রথাগত মঙ্গলকাব্য ? উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দিন।
শিবায়ন প্রথাগত মঙ্গলকাব্য নয়। কারণ–
(১) মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে দেবদেবীর পূজা প্রচারের উদ্দেশ্যে শিবায়ন রচনার পশ্চাতে সে উদ্দেশ্য ছিল না– কারণ উঁচু সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য শিবকে অন্যদের মতাে প্রতিযােগিতায় নামতে হয়নি।
(২) মঙ্গলকাব্যের মতাে শিবায়নে দেব খন্ড ও নরখন্ড নেই। রয়েছে কেবল শিবের ঘর গৃহস্থালীর বিবরণ।
আরও দেখে রাখতে পারো 👉 প্রশ্নোত্তরে নাথসাহিত্য
৫.’শিবায়ন’ কাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি কে ? তার শ্রেষ্ঠত্বের কারণ কী ?
শ্রেষ্ঠ কবিঃ ‘শিবায়ন’ কাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি হলেন – রামেশ্বর ভট্টাচার্য ।
শ্রেষ্ঠত্বের কারণঃ রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবায়ন’ কাব্যধারায় শ্রেষ্ঠত্বের কারণগুলি হলো –
(i) বাঙালি কৃষক জীবনের নিখুঁত পরিচয় দান।
(ii) সহজ-সরল ভাষায় কাহিনি বর্ণন।
(iii)শিব-দুর্গা চরিত্রের মধ্যে দৈবী মাহাত্ম্যের চেয়ে মানবিক বৈশিষ্ট্য বেশি করে দেখানো।
(iv) পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনির মেলবন্ধন ঘটানো।
৬.বাংলায় ‘শিবায়ন’ কাব্যধারার জনপ্রিয়তার কারণগুলি কী কী ?
জনপ্রিয়তার কারণঃ বাংলায় শিবায়ন কাব্যধারার জনপ্রিয়তার কারণগুলি হলো-
(i) ‘শিবায়ন’ কাব্যে শিব ও তার গার্হস্থ্য-জীবন গ্রাম্য সাধারণ মানুষের মতো।
(ii) পৌরাণিক শিব অপেক্ষা গ্রাম্য শিবের চরিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।
(iii) বাংলায় ‘শিবায়ন’ কাব্যধারার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হল – দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের মধ্যে শিবের গ্রহণযোগ্যতা।
(iv) এছাড়াও রয়েছে শিব চরিত্রের Flexibility ।
৭। মৃগলুব্ধ কী ? এর দুজন কবি ও তাদের গ্রন্থের নাম লিখুন।
মৃগলুব্ধঃ চট্টগ্রামে শিব মহিমা বিষয়ে যে কয়েকটি পৌরাণিক পুঁথি পাওয়া যায় তাকে মৃগলুব্ধ বলে।
দুজন কবি ও তাদের গ্রন্থঃ ‘মৃগলুব্ধ ‘ কাব্যের দুজন কবি ও তাদের গ্রন্থ হলো –
(i) রামরাজা-র “মৃগলুব্ধ সংবাদ ”
(ii) রতিদেব-এর “মৃগলুব্ধ ” ।
প্রশ্নোত্তরে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ( প্রাচীন ও মধ্যযুগ)
৮। শিবায়ন কাব্যধারার কবি ও তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিনঃ
শিবায়ন কাব্যধারার কবিঃ শিবায়ন কাব্যধারার প্রধান কবি্রা হলেন শংকর কবিচন্দ্র, রামকৃষ্ণ রায়, রামেশ্বর চক্রবর্তী( ভট্টাচার্য্য), দ্বিজ কালিদাস, দ্বিজ মণিরাম প্রমুখ।
১. শংকর কবিচন্দ্র :
জন্মঃ সপ্তদশ শতকের শিবায়ন কাব্যের কবি শংকর কবিচন্দ্র বিষ্ণুপুরের। এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।
পৃষ্ঠপোষকঃ বিষ্ণুপুরের রাজা গােপালসিংহের সভাকবি শংকর কবিচন্দ্র রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, শীতলামঙ্গল এবং শিবায়ন কাব্য রচনা করেন।
কাব্য পরিচয়ঃ শংকর কবিচন্দ্রের লেখা শিবায়ন কাব্যের পুরাে পুথি পাওয়া যায়নি। ১৬৮০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে লেখা শিবায়ন কাব্যের ‘মাছধরা পালা’ শীর্ষক একটি পালা পাওয়া গিয়েছে। এ পালাটি।বাস্তবধর্মী ও চিত্তাকর্ষক। দেবী পার্বতী মেছুনীর বেশ ধরে শিবকে কামাবিষ্ট করলে শিবের যে আচরণ প্রকাশ পেয়েছে তা গ্রাম্যরুচি সুলভ। ভাগবতামৃত কাব্যের ভূমিকায় মাখনলাল মুখােপাধ্যায় কবির ‘শঙ্খ পরা’ নামে আর একটি পালার কথাও উল্লেখ করেছেন।
কবির কৃতিত্বঃ
i) সহজ সরল ভাষায় কাব্য রচনা।
ii) লৌকিক কাহিনিকে বেশি প্রাধান্য দান ।
iii) গার্হস্থ্য জীবনের নিখুঁত পরিচয় তুলে ধরা।
iv) একটি দৃষ্টান্তঃ ” সাক্ষাতে হইল মাতা বাগদিনি বেশ।/ সই সই বলি প্রভু হাসে ব্যমকেশ।।” (‘মর্চ্ছধরা পালা’)
২. রামকৃষ্ণ রায় বা রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্র
জন্মঃ সম্ভবত ১৬১৮ খ্রীস্টাব্দে কবি রামকৃষ্ণের জন্ম। সপ্তদশ শতকের কবি রামকৃষ্ণ রায় হাওড়া জেলার আমতার নিকটবর্তী রসপুর গ্রামের কৃষ্ণরায় ও রাধাদাসীর পুত্র।
কাব্য পরিচয়ঃ ” শিবমঙ্গল” নামে তিনি তাঁর “শিবায়ন” কাব্যটি রচনা করেছিলেন। কাব্যটির আনুমানিক রচনাকাল ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে। কাব্যটি মুদ্রিত হয়নি । প্রায় ৮০০০ পদে কাব্যটি সম্পূর্ণ।
পঁচিশটি পালায় কাব্যটি বিভক্ত। এতে হরিবংশ, কালিকাপুরাণ, পুরাণ, স্কন্দপুরাণ মহাভারত প্রভৃতি উৎস থেকে শিবকাহিনী সংগৃহীত হয়েছে। পৌরাণিক শিবকাহিনির সঙ্গে লৌকিক শিবকাহিনির সংযােগ ঘটিয়েছিলেন তিনি।
হরগৌরীর বিবাহ ও কোন্দল বর্ণনায় কবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ রায় বাংলার সমাজজীবন ও গার্হস্থ্যচিত্ৰকেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
৩.রামেশ্বর চক্রবর্তী ( ভট্টাচার্য্য)
জন্মঃ রামেশ্বর চক্রবর্তী ( ভট্টাচার্য্য)-র জন্ম হয় ১৬৭৭ সালে। কবির জন্মস্থান মেদিনীপুর জেলার বরদা পরগনার যদুপুর(ঘাটাল) গ্রাম ,
কবির বংশ পরিচয়ঃ পিতামহ গোবিন্দ চক্রবর্তী বেদজ্ঞ পন্ডিত । পিতা লক্ষণ ও মাতা রুপবতী । দুই পত্নী সুমিত্রা ও পরমেশ্বরী । যজন -যাজনের জন্য” ভট্টাচার্য” পদবি গ্রহণ। অর্থাৎ ভট্টনারায়ণ মনির বংশজ যতি নারায়ণ চক্রবর্তী–গােবর্ধন চক্রবর্তী, পত্নী রূপবতী- রামেশ্বর ও ভাই শম্ভুরাম। রামেশ্বরের দুই স্ত্রী—–সুমিত্রা ও পরমেশ্বরা, নিবাস অযােধ্যানগরী এবং পূর্ববাস সম্পর্কে বলা হয়েছে–
‘পূর্বাবাস বিষ্ণুপুরে হেমৎসিংহ ভাঙে ঘরে
রাজারাম সিংহ কৈল প্রীত।
স্থাপিয়া কৌশকী তটে বরিয়া পুরাণ পাঠে
রচাইল মধুর সঙ্গীত।
‘(বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য/আহমদ শরীফ)
কাব্যের নামঃ ‘শিবায়ন’ বা ‘শিবসংকীর্তন‘। কবির বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি বিশেষ আনুগত্য ছিল এবং মোট আটটি পালায় তাঁর কাব্যটির সমাপ্তি ।তাই এটি ‘অষ্টমঙ্গলা” নামে পরিচিত।
কাব্যটির সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ পৌরাণিক ও লৌকিক দুটি অংশে বিভক্ত রামেশ্বরের কাব্যের প্রথম পাঁচটি পালায় রয়েছে পুরাণভিত্তিক সৃষ্টি কাহিনী, দেবতাদের উৎপত্তি, নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে হরপার্বতীর বিবাহ। আর শেষ তিনটি পালায় লৌকিক কাহিনী ভিত্তিক শিবের গার্হস্থ্য জীবন, দাম্পত্য কলহ, চাষাবাদ, মাছধরা প্রভৃতি প্রসঙ্গ খুবই জীবন্তভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যষ্ঠ পালায় বর্ণিত হয়েছে, পার্বতীর গঞ্জনায় মহাদেবের কৈলাস ত্যাগ ও কৃষিকাজের সূচনা। সপ্তম পালায় স্থান পেয়েছে শিবের মাছধরা, বাঙ্গিনীবেশিনী মহামায়ার শিবকে ছলনা, শিব পার্বতীর কৈলাস যাত্রা। এবং শেষ পালা তথা জাগরণ পালায় রয়েছে গৌরীর শাখা পরার বাসনা— অভিমানে পিতৃগৃহে গমন। শাঁখারীর বেশে শিবের শ্বশুরবাড়ি যাত্রা এবং শেষ পর্যন্ত হরগৌরীর মিলন
পৃষ্ঠপোষকঃ কবির পৃষ্ঠপোষক ও অনুরাগী রাজা যশোবন্তসিংহের সময়ে কাব্য রচিত ।কবি তাঁর রাজসভার সভাকবি ছিলেন ।অনুমান হয় শিবায়ন কাব্য রচনার শুরু রাম সিংহের আমলে এবং সমাপ্তি তাঁর পুত্র রাজা যশোবন্ত সিংহের আমলে। আনুমানিক ১৭৪৪/৪৫ এ কবির মৃত্যু হয় এবং কবির উপাধি ছিল “কবিশেখরী” ।
অন্যান্য রচনাঃ
কবির ভণিতার চার খানি পুঁথির সন্ধান পাওয়া যায় —
i)শিব সংকীর্তন /শিবায়ন ।
ii) সত্যপীরের ব্রতকথা ।
iii) শীতলামঙ্গল ।
iv) সত্য নারায়ণের ব্রতকথা ।
রামেশ্বর ভট্টাচার্যের কৃতিত্বঃ
i) সহজ সরল ভাষায় পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনির সমন্বয় সাধন।
ii) হর গৌরির গার্হস্থ্য জীবনের বর্ণনায় গ্রামীণ কৃষি জীবনের নিখুঁত পরিচয় তুলে ধরা।
iii) ভাষার ঐশ্বর্য , ছন্দ-অলঙ্কার সর্বোপরি কবিত্বগুনে তিনি শিবায়ন ধারার শ্রেষ্ঠ কবি ।
iv) তাঁর কিছু কিছু পংক্তি প্রবাদ বাক্যের মর্যাদা পেয়েছে। যেমন- “দিনে হও ব্রম্মচারী রাত্রে গলাকাটা।”
আরও পড়তে পারো 👉 প্রশ্নোত্তরে আরাকান রাজসভার সাহিত্য
৪. দ্বিজ কালিদাস
দ্বিজ কালিদাস’ ‘কালিকাবিলাস’ নামে এক শিবচরিত এর রচয়িতা । কবি সম্ভবত আঠারাে শতকের শেষপাদের লােক। সংস্কৃতপুরাণ ও কালিদাসের কুমারসম্ভব’ কাব্যের অনুসৃতি রয়েছে এর পাঁচালীতে। এ পাঁচালীতে আগমনী আর বিজয়া গানও রয়েছে। এতে গুরুত্ব দিয়েই হয়তাে কবি ‘কালিকাবিলাস’ নাম রেখেছেন তাঁর কাব্যের ।
৫. দ্বিজ মণিরাম
দ্বিজ হরিহরপুত্র দ্বিজ মণিরাম ওরফে দ্বিজ সুন্দর বা সুন্দর রায় বৈদ্যনাথমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা। কবি সম্ভবত সিলেটবাসী ছিলেন। দেওঘরের বৈদ্যনাথ শিবই বৈদ্যনাথমঙ্গলে বর্ণিত বিষয় । এই বৈদ্যনাথ কুষ্ঠ অন্ধত্ব প্রভৃতি রােগের নিরাময়কারী হিসেবে তাঁর কাব্যে প্রতিষ্ঠিত। যেমন-
“অন্ধ রােগী জরা ব্যাধি কুষ্ঠেত বিখ্যাত।
দরশন মাত্রে মুক্ত করে জগন্নাথ।।”
★আঠারাে ও উনিশ শতকের দ্বিজ ভগীরথ, রাজাপৃথিচন্দ্র, হরিচরণ আচার্য, প্যারীলাল মুখােপাধ্যায়, দ্বিজ রামচন্দ্র, প্রাণচন্দ্র, দ্বিজ সৃষ্টিধর প্রমুখ কবিও হরচরিত্র বা শিব মাহাত্ম্য রচনা করেন।
প্রস্তুতির জন্য 👇 পরীক্ষাগুলি দিতে পারোঃ👇
১। সাহিত্যের ইতিহাস প্রাচীন ও মধ্যযুগ) MCQ
৪। কারক অ-কারক SAQ Practice SET
৫। শব্দভাণ্ডার MCQ Practice SET
৬। কাব্যসাহিত্যের ইতিহাস (আধুনিক যুগ) MCQ
৭। ধ্বনি ও বর্ণ MCQ practice SET
৮। মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস SAQ SET
৯। সাহিত্যের রূপরীতি/ নাট্য সাহিত্য SAQ
আরো দেখে রাখতে পারো👇👇👇
বাংলা কাব্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত-র অবদান
বাংলা কাব্যে কবি-মাইকেল মধুসূদন দত্তর অবদান
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর অবদান
বাংলা কাব্যে কবি মোহিতলাল মজুমদারের অবদান
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-র অবদান
বাংলা কাব্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান
গীতিকবিতার ভোরের পাখি কাকে বলে হয় ? বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান আলোচনা করো ।
বাংলা কাব্য সাহিত্যে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা কাব্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা কাব্যে বিষ্ণু দে-র অবদান আলোচনা
আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের অবদান
গদ্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান
প্রবন্ধ সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান
প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর অবদান
প্রবন্ধ সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান
কথা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান