বিনয় ঘোষ (১৯১৭ -১৯৮০) || বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে বিনয় ঘোষ ( কালপেঁচা) এর অবদান
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ই জুন কলকাতার মনোহরপুকুরে বিনয় ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বিশ্বেশ্বর ঘোষ। পেশায় ছিলেন একজন সামান্য কেরানি। মাতা সরসীবালা দেবী। পৈতৃক নিবাস ছিল তৎকালীন যশোহর জেলার বনগাঁ গোড়াপাড়া গ্রাম। তাঁর পড়াশোনা হয়েছিল পাড়ার কাছে নীরদ মাস্টারের পাঠশালায়। পরে তিনি ক্যাথিড্রাল স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর তিনি আশুতোষ কলেজ থেকে আই এ এবং অর্থনীতিতে অনার্স সহ বি এ পাশ করেন। বি এ পাশ করার পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস এবং সংস্কৃতি (নৃতত্ত্ব) বিষয়ে স্নাতোকত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি নৃতত্ত্ব বিষয়ে প্রখ্যাত অধ্যাপক নীহার রঞ্জন রায়ের অধীনে গবেষণা করার ইচ্ছে থাকলেও নানান কারণে তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাপ্তাহিক ‘ফরোয়ার্ড পত্রিকা’-য় সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর কর্ম জীবন শুরু করেন। এছাড়াও তিনি ‘যুগান্তর’, দৈনিক ‘বসুমতী’ এবং সাপ্তাহিক ‘অরণি’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। তিনি ‘কালপেঁচা’ ছদ্ম নামেও পরিচিত।
বিনয় ঘোষের প্রবন্ধগ্রন্থ:-
কালপেঁচার নকশা (১৯৫১), টাউন কলিকাতার কড়চা (১৯৬০), সুতানুটি সমাচার (১৯৬১), নববাবু চরিত (১৯৭৯), কলকাতার কালচার (১৯৫৩), পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি , বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ (১৯৫৮), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র (১৯৬০), মেট্রোপলিটন(১৯৬০), বাংলার নবজাগৃতি (১৯৪৮), বিদ্রোহী ডিরোজিও (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ), জনসভার সাহিত্য (১৩৬২) প্রভৃতি।
বিনয় ঘোষের উপন্যাস :-
- ‘৩০৪’
বিনয় ঘোষের ছোটগল্প সংকলন:-
- ডাষ্টবিন (১৯৮০)
বিনয় ঘোষের প্রবন্ধগ্রন্থ ও তার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য –
১. কালপেঁচার নকশা (১৯৫১) –
- গ্রন্থে লেখক দৈনন্দিন ‘সংলাপীয় ভঙ্গি’র ব্যবহার করেছেন। লেখক ‘কালপেঁচা’ ছদ্মনামে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ‘কালপেঁচার দুকলম’ এবং ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ‘কালপেঁচার বৈঠকে’ প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন।
- বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে বিনয় ঘোষ ( কালপেঁচা) এর অবদান
২. টাউন কলিকাতার কড়চা (১৯৬০)
- গ্রন্থটিতে আছে সমকালীন কলকাতার নাগরিক জীবনের নানা চিত্র। লেখকের ‘কলকাতা কালচার’ গ্রন্থের পরিপূরক এই রচনাটি।
- মোট ৯টি প্রবন্ধ আছে এই গ্রন্থে। প্রবন্ধগুলি হল ‘ট্যাভার্ন ও কফিহাউস’, ‘সাহেব নবাবদের টাউন’, ‘নতুন বাঙালী বড়লোক’, ‘পালকি ও ল্যান্ডের যুগ’, ‘ক্রীতদাস ও কুলিমজুর’, ‘নতুন শহরে পুরাতন ভৃত্য’, ‘ডুয়েল’, ‘সেদিনের ইংরাজ বিচারক’ এবং ‘মধ্যবিত্তের বৈচিত্র’।
৩. সুতানুটি সমাচার (১৯৬১) –
- সমগ্র গ্রন্থটি ৪টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। অধ্যায়গুলির শিরোনাম যথাক্রমে ‘উইলিয়াম হিকির স্মৃতিকথাঃ ১৭৭৭-১৮০৮’, ‘এলিজা ফে’র চিঠিপত্র’, ‘ফ্যানি পার্কস্-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত’ এবং ‘ভিকতর জ্যাকমোর চিঠি।
- গ্রন্থটি সাহিত্যিক শ্রী পরিমল গোস্বামীকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
৪. নববাবু চরিত (১৯৭৯) –
- গ্রন্থটির পূর্বনাম ‘শ্রীবৎসের নানা প্রসঙ্গ’। দ্বিতীয় সংস্করণে বর্তমান নামটি গ্রহণ করা হয়। ‘যুগান্তর’ ও অন্য কয়েকটি সাময়িক পত্রিকায় গ্রন্থের লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল।
- গ্রন্থে মোট প্রবন্ধের সংখ্যা ৮টি। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রবন্ধ হল ‘পাঁকাল বন্দনা’, ‘মধ্য-বিত্ত’, ‘নববাবুকথা’, ‘কাক-কয়লা’ ইত্যাদি।
(৫)কলকাতার কালচার (১৯৫৩),
(৬) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (১৯৫৭)
- এই গ্রন্থটির জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরষ্কার পেয়েছেন ।
- দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিনয় ঘোষ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্নজেলার পরিভ্রমণ শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার, গ্রামবাংলার অনুদ্ঘাটিত ভগ্ন ইতিহাস, জীবনযাপন পুরাবৃত্তের অনুসন্ধান করেছেন। তাঁর একটা অক্ষেপ ছিল ‘উত্তরবঙ্গ টা তেমন করে দেখা হল না’।তাঁর এই গ্রন্থে পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতায় ফুটে উঠেছে। এই
- গ্রন্থ টি কে লেখক ৪ টি খণ্ডে বিভক্ত করে বিভিন্ন জেলারইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন।প্রথম খণ্ডে বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া।দ্বিতীয় খণ্ডে হাওড়া, হুগলী ও মেদনীপুর। তৃতীয় খণ্ডে চব্বিশ পরগণা, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া গেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন এবংচতুর্থ খণ্ডে এই খণ্ডে বাকী ৩ খণ্ডে প্রকাশিত জেলাগুলির বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক বিষয় তুলে ধরেছেন।
(৭) বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ (১৯৫৮)
(৮) সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র (১৯৬০)
- গ্রন্থ টি ৫ খণ্ডে বিভক্ত।
- গ্রন্থ টি রচনার পরিকল্পনা করেন ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে এবং সমাপ্তৎকরেন ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে।
- তিনি উনিশ শতকীয় পত্র পত্রিকা তত্ত্ববোধনী, সংবাদ প্রভাকর, বিদ্যাদর্শন, সংবাদ ভাস্কর, সর্বশুভাকরী, সোমপ্রকাশ, বেঙ্গল স্পেকটেটর পত্রিকা ইত্যাদি থেকে রসদ সংগ্রহ করেছেন।
- এই গ্রন্থের শেষ অর্থাৎ পঞ্চম খণ্ড টি স্বতন্ত্র ভাবে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে “বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা” নামে প্রকাশিত হয়।
(৯) মেট্রোপলিটন(১৯৬০),
(১০) বাংলার নবজাগৃতি (১৯৪৮),
(১১) বিদ্রোহী ডিরোজিও (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ),
(১২) জনসভার সাহিত্য (১৩৬২)
বিনয় ঘোষের গদ্যশৈলি:-
গদ্যরীতির বক্তব্য নির্ভরতা মূলত নির্ভর করে প্রাবন্ধিকের স্বচ্ছতার উপর। বিনয় ঘোষ আলোচ্য প্রবন্ধে দুরূহ বিষয়কে স্পষ্ট করেছেন— স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা। যেমন, গ্রাম ও শহরের মধ্যে যে ব্যবধান তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটিয়েছেন—“গ্রাম-শহর-নগরের মতো সচল ও গতিশীল না হলে, জাতির সংস্কৃতি কখনও জনসাধারণের সম্পদ হবে না, মুষ্টিমেয়ের ভোগবিলাসের সামগ্রী হয়ে থাকবে। তার চেয়েও ক্ষতিকর ফল হবে এই (এবং যা অধিকাংশ প্রান্তীয় গ্রামাঞ্চলে হয়েছে দেখা যায়) যে, নগর শহরের পাঁচমিশালি সংস্কৃতির তলানিটুকু চুঁইয়ে এসে প্রান্তীয় অঞ্চলের জড়ত্বকে আরও বেশি বিষিয়ে তুলবে। নাগরিক সংস্কৃতির ভালটুকুর বদলে মন্দটুকুই তার ভাগ্যে জুটবে। এবং সেই মন্দের বিষক্রিয়ায় জর্জরিত হয়ে উঠবে তার জড়জীবন।” প্রাবন্ধিকের এই দৃষ্টিভঙ্গি এত স্বচ্ছ বলেই তা বর্তমানের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য।
‘সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র’ গ্রন্থটি প্রবন্ধ সাহিত্যে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের নিরিখে অনবদ্য। গবেষণালব্ধ তথ্যকে বিশ্লেষণের সাহায্যে বাস্তবরূপে তিনি উপস্থাপন করেছেন। বিদ্যাসাগরের মতো অসাধারণ বাঙালি চরিত্রকে সমকালীন প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি।
……………………………………………
আরো দেখে রাখতে পারো👇👇👇
নাট্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান
নাট্যসাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান
নাট্যসাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবদান
নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্র-র অবদান
নাট্যসাহিত্যে মধুসূদন দত্ত-র অবদান
বাংলা কাব্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত-র অবদান
বাংলা কাব্যে কবি-মাইকেল মধুসূদন দত্তর অবদান
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর অবদান
বাংলা কাব্যে কবি মোহিতলাল মজুমদারের অবদান
বাংলা কাব্য-সাহিত্যে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-র অবদান
বাংলা কাব্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান
গীতিকবিতার ভোরের পাখি কাকে বলে হয় ? বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান আলোচনা করো ।
বাংলা কাব্য সাহিত্যে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা কাব্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা কাব্যে বিষ্ণু দে-র অবদান আলোচনা
আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের অবদান
গদ্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান
প্রবন্ধ সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান
প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর অবদান
প্রবন্ধ সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান
কথাসাহিত্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান
কথাসাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান
কথাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান
উপন্যাস সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান
বাংলা ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান